মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪১ অপরাহ্ন
শাহীন হাসনাত:
মানুষ সামাজিক জীব। প্রতিদিন নানা পর্যায়ের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুন্দর শব্দ প্রয়োগ এবং ভদ্রতার সঙ্গে কথা বলা জরুরি। সুন্দর কথা বলার অর্থ অন্যের যা ভালো লাগে সে ধরনের কথা বলে তার মন জয় করা নয় বরং সুন্দরভাবে কথা বলার অর্থ হলো সর্বোত্তম শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে কল্যাণকর কথা বলা।
কথোপকথনের সময় কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা দরকার। কারও সঙ্গে কথা বলার সময় তার অবস্থান ও মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রাখা, যার সম্পর্কে কথা বলা হচ্ছে; তার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে হবে। অনেকে নিজের অপছন্দনীয় ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে এমন সব শব্দ, বাক্য ও তথ্য ব্যবহার করেন, যা থেকে একজন শ্রোতা, খোদ বক্তা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পান। এ কারণে কোনো শত্রু সম্পর্কে কথা বলতে গেলেও শালীনতা ও সীমা মেনে চলা আবশ্যক। যারা অবলীলায় অন্যের গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেন, তাদের কেউ বিশ্বাস করে না, তাদের কেউ পছন্দ করে না।
কথা বলার একটি আদব হচ্ছে, গোপনীয়তা রক্ষা করা। অনেকেই আছেন যারা কোনো কথা গোপন রাখতে পারেন না। কারও সম্পর্কে কিছু শোনার পর তা দ্রুত অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেন। একবারও ভেবে দেখেন না, ওই তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুনাম ক্ষুন্ন করতে পারে, তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইসলাম ধর্মে অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি বিষয়, এক জায়গায় কয়েকজন থাকলে কাউকে বাদ দিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা শিষ্টাচারের লঙ্ঘন, এটা মনে রাখা। যাকে বাদ রেখে কথা বলা হয়, তিনি কষ্ট পেতে পারেন; অপমানবোধ করতে পারেন। কেউ কেউ কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। এটা মন্দ নয়, মানুষের স্বভাববিশেষ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অপ্রয়োজনীয় কথা কেউ শুনতে পছন্দ করেন না। এ ছাড়া একই কথা বারবার বললে তা কারও কাছে ভালো লাগে না। বলার মতো কিছু না থাকলে নীরব থাকাই শ্রেয়। এ অবস্থায় চুপ করে অন্যের কথা শুনতে হবে। অন্যের বক্তব্য থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। জ্ঞানীরা বলেছেন, ‘যে বেশি কথা বলে, তার ভুল বেশি হয়। আর বেশি ভুল করলে তার বিবেক মারা যায়। আর যার বিবেক মারা যায়, তার স্থান হচ্ছে দোজখ। ’
তাই কথা বলার আগে ভেবে নিতে হবে, আপনি কোন বিষয়ে কথা বলবেন এবং যে বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন; সে বিষয়টির প্রভাব ও পরিণতি কী। মুখ দিয়ে বের হওয়ার পর সাধারণত সেটার ওপর আর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কাজেই ভেবে-চিন্তে কথা বলার কোনো বিকল্প নেই।
বিভিন্ন সময় দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ে কথা বলার পর এর পরিণতি উপলব্ধি করে অনুশোচনা করছেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, একটি মন্তব্যের কারণে পারস্পরিক সম্পর্কে এমন ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যা আর কোনো দিন ঠিক হওয়ার নয়। অনেক সময় আমরা অন্যের কথা বা মন্তব্যকে ভুল বুঝে মন খারাপ করি। এ কারণে এমন কথা বলা উচিত নয়, যা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
অনুশোচনা করার চেয়ে ভেবে-চিন্তে কথা বলা উত্তম। বলা হয়, যা বিবেকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই হচ্ছে সর্বোত্তম কথা। যে কথা শ্রোতা গ্রহণ করে এবং তাতে কোনো অকল্যাণ নেই তা উত্তম কথা। ভালো ও সুন্দর কথা এবং নম্র আচরণ মানুষের অমূল্য সম্পদ। ভালো কথার মাধ্যমে একজন ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকেও স্থির ও শান্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণত অন্যের রাগ, ক্ষোভ, গালমন্দ ও অপমানের মোকাবিলায় নীরবতা ভালো ফল দেয়। পাশাপাশি ঝগড়া না করে ক্ষুব্ধ ব্যক্তির সঙ্গে সদাচরণ করার অর্থ হলো, মন্দ মানুষকেও ভালো আচরণ শিক্ষা দেওয়া। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে মন্দ আচরণের মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন আসে এবং ভালো ব্যবহার করতে শেখে।
নম্র-ভদ্র আচরণ মৃদু ও কোমল বাতাসের মতো, যা মানুষের মনকে আলোড়িত করে এবং প্রশান্তির জন্ম দেয়। মানবসমাজের সর্বোত্তম আদর্শ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কেউ কোনো আবেদন করলে তিনি তা গ্রহণ করার চেষ্টা করতেন। সম্ভব না হলে অত্যন্ত নরম সুরে সুন্দরভাবে তা জানিয়ে দিতেন, রুক্ষ আচরণ করতেন না।
মানুষের কথা ও বক্তব্য হচ্ছে তার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। জ্ঞানীদের মতে, সত্য কথা সর্বোত্তম কথার অন্তর্ভুক্ত। মিথ্যাচার কখনোই উত্তম কথা হতে পারে না। নম্র ও ভদ্রভাবে উপস্থাপিত কথা সর্বোত্তম কথা, সর্বোত্তম কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকবে। যে কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই, তা সর্বোত্তম কথা হতে পারে না। সর্বোত্তম কথা অন্যের জন্য বিরক্তিকর হয় না, সর্বোত্তম কথা হয় স্বল্প কিন্তু অর্থপূর্ণ ও সবার কাছে বোধগম্য।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক